উইল মানে কি? উইলের বিস্তারিত বর্ণনা।

উইল অর্থ ইচ্ছা। মুসলিম আইনে উইল হলো একটি আইনগত ঘোষণা। এই আইনগত ঘোষণার মাধ্যমে ঘোষণাকারী তার সম্পত্তি সম্পর্কিত কোনো ইচ্ছা বা বাসনা তার মৃত্যুর পর পূরণ হোক এটা প্রকাশ করে।

উইলের সংজ্ঞা

উইল সমাজের একটি অতি পরিচিত নাম। তবে এর আইনগত সংজ্ঞা দিয়েছেন বিখ্যাত আইনবিদরা।
উইলের সংজ্ঞায় প্রখ্যাত আইনবিদ জারমান বলেন, ‘উইল হলো এমন একটি দলিল, যা দ্বারা কোনো ব্যক্তি তার সম্পত্তির এমন বিলিব্যবস্থা করতে পারে, যা উইলকারীর মৃত্যুর পর কার্যকরযোগ্য।’ আইনের ভাষায় উইল হচ্ছে, কোনো সুনির্দিষ্ট জিনিসের বা মুনাফার বা কোনো সুবিধাদির মধ্যে আনুতোষিক বা উপহার প্রদানের পদ্ধতিতে উইলকারীর মৃত্যু পর্যন্ত তা স্থগিত রাখার অধিকার দান করা। একজন উইলকারীর উইল মৃত্যুর মুহূর্ত থেকে কার্যকর হয়। যে উইল করে তাকে উইলকারী এবং যার নামে উইল করা হয় তাকে উইল-গ্রহীতা বলা হয়। উইলের মূল উৎস কোরআন। ১৯২৫ সালের উত্তরাধিকারী আইনের ২ (এইচ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো হিন্দু জীবদ্দশায় (তাহার মৃত্যুর পর) যাবতীয় সম্পত্তি কিভাবে বিলিব্যবস্থা হইবে তাহা যদি কোনো লিখিত দলিল দ্বারা নিরুপণ করিয়া যায়, তবে তাহাকে উইল বলে।

উইল করার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি

মুসলিম আইনে সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে উইল একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। উইল কোরআন-হাদিস সংক্রান্ত আইনবিশেষ। নাবালক নয়, এমন প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্কের মুসলমানই উইল বা অছিয়তের মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারে। কোনো নাবালকের ক্ষেত্রে যেখানে ওই নাবালক ও তার সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য একজন অভিভাবক নিযুক্ত করা হয়েছে অথবা ওই নাবালকের ২১ বছর পূর্ণ হলেই সে পূর্ণবয়স্ক হয়েছে বলে ধরা হবে। মুসলমানদের ক্ষেত্রে নাবালকত্বের বয়সসীমাটি উইল, দানপত্র, ওয়াকফ ইত্যাদি বিষয়ে ১৮ বছর পূর্ণ হলেই চলে। উইলের মূল বিষয়, হস্তান্তরটির ব্যাপারে দাতার পূর্ণ উপলব্ধি বা বোঝার ক্ষমতা। তবে এক. উইল করার সময় উইলকারীর মন সুস্থ থাকা আবশ্যক। বিকৃত মস্তিষ্কের উইল অসিদ্ধ হবে। দুই. যেকোনো চুক্তিপত্র করতে মুক্ত সম্মতি প্রয়োজন হয়, উইলেও তা দরকার। শক্তিপ্রয়োগে বাধ্য করে উইল করে নিলে তা গ্রাহ্য হবে না। তিন. উত্তরাধিকারিত্ব আইনানুসারে একজন সুস্থ মস্তিষ্কের সাবালক ব্যক্তি তার যাবতীয় পৃথক অথবা নিজ উপার্জিত সম্পত্তি অন্যের বরাবর উইল করে দিতে পারে, তবে দানের মতো উইলকারী যে ব্যক্তিদের ভরণপোষণ দিতে আইনগত বাধ্য ছিল তাদের জন্য ভরণপোষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা করে বাকি সম্পত্তি উইল করতে পারবে। যেমন: ১. একজন বিবাহিত রমণী তার উপার্জিত সম্পত্তি উইল করতে পারে। ২. অন্ধ, বোবা ও বধির ব্যক্তি উইলের মর্ম অবগত হতে পারলেও উইল করতে পারবে না। ৩. সাময়িকভাবে অপ্রকৃতস্থ ব্যক্তি যখন সুস্থমনা থাকে তখন উইল করতে পারে। ৪. উইলের মর্ম চিররুগ্ণ বা অসুস্থতার কারণে অবগত হতে অপারগ হলে কেউ উইল করতে পারবে না। উত্তরাধিকারিত্ব আইনের বিধান অনুসারে উইল প্রতারণা, বলপ্রয়োগের দ্বারা করা হলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। উইলকারী যেকোনো উইল রদ ও পরিবর্তন করতে পারে এবং সর্বশেষ উইল কার্যকর বলে গণ্য হবে। উত্তরাধিকারিত্ব আইনানুসারে উইলটি অবশ্যই লিখিত দলিল দ্বারা হতে হবে এবং উইলকারী কমপক্ষে দুইজন সাক্ষীর সম্মুখে দলিলের সব বিষয় অবগত হয়ে তাতে স্বাক্ষর করবেন। দুইজন বা এর অধিক প্রত্যয়নকারী হিসেবে উইলে স্বাক্ষর করবেন।

ভিন্ন ধর্মের অনুকূলে উইল

মুসলিম ধর্মের বাইরে উইলকারী ও উইল-গ্রহীতা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হতে পারে, তা উইল নাচক করবে না। সুতরাং একজন মুসলমান এক অমুসলিমের পদে উইলে সম্পত্তি দান করতে পারে যদি ওই অমুসলিম বিদেশি না হয়। আবার একজন অমুসলিমকে উইল দ্বারা সম্পত্তি প্রদান করতে পারে। তবে শত্রুপক্ষীয় কোনো দেশের অমুসলিমের উদ্দেশে উইল বাতিল হবে যখন ওই দেশ বিপক্ষে যুদ্ধরত থাকে।
সম্পত্তির কত অংশ উইল করা যায়
কোনো মুসলমান তার দাফন-কাফন ব্যয় ও দেনা পরিশোধের পর, উদ্বৃত্ত সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের অধিক উইলমূলে হস্তান্তর করতে পারে না। উইলকারীর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীরা সম্মতি না দিলে উইলের মাধ্যমে বৈধ এক-তৃতীয়াংশের অধিক পরিমাণ সম্পত্তি দান কার্যকর হবে না।
পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়নি এমন ব্যক্তির ব্যাপারে উইল
নিম্নলিখিত ক্ষেত্র ব্যতীত এখনো ভূমিষ্ঠ হয়নি এমন ব্যক্তির বরাবরে উইল বাতিল বলে গণ্য হবে। (ক) যে ক্ষেত্রে যার বরাবরে উইল করা হয়, সে একটি ঋণ মাত্র এবং উইল করার ছয় মাসের মধ্যে ভূমিষ্ঠ হয়, অথবা (খ) যে ক্ষেত্রে উইলগ্রহণকারীরা কোনো বিশেষ ব্যক্তির অনির্ধারিত ছেলেমেয়ে এবং তার উইলকৃত সম্পদ মৃত্যুর সময় বিদ্যমান থাকে। উইল করার সময় বিদ্যমান নেই, কিন্তু উইলকারী ব্যক্তির বরাবরে উইল বৈধ।

উইল মৌখিক বা লিখিত

ইল বা অছিয়ত মৌখিক অথবা লিখিতভাবে কার্যকর করা চলে। ‘মুসলিম আইনে কোনো উইল বা অছিয়তকে বৈধ করার জন্য লিখিতভাবে তা প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয়তা নেই এবং যতক্ষণ পর্যন্ত উইল প্রদানকারীর উইল করার ইচ্ছে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো বিশেষ আকৃতি এমনকি কোনো মৌখিক ঘোষণারও প্রয়োজন নেই।’
উইল অসিদ্ধ হওয়া
উইলকারীর মৃত্যুর আগেই উইলের মাধ্যমে সম্পত্তিগ্রহীতা মৃত্যুবরণ করে থাকে তখন উক্ত উইল অসিদ্ধ হয়ে যাবে এবং উইলকৃত সম্পত্তি পুনরায় উইলকারীর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হবে। বিধানটি উত্তরাধিকার আইন, ১৯২৫-এর ১০৫ ধারার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যদিও ওই ধারা মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। শিয়া আইনে এ ক্ষেত্রে উইলের মাধ্যমে সম্পত্তিগ্রহীতার ওয়ারিশরা উইলকৃত সম্পত্তি পাবে, যদি না উইলকারী উইল নাকচ করে দেয়। কিন্তু উইলের সম্পত্তিগ্রহীতার কোনো ওয়ারিশ না থাকলে উইলকৃত সম্পত্তি উইলকারীর ওয়ারিশরা প্রাপ্য হবে। উইলে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে দান : দানের উদ্দেশ্য অনুসারে উইলে ধর্মীয় দান মোট তিন প্রকার হতে পারে।

যেমন:

(১) ফরজ কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে দান, অর্থাৎ পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে দান। যথা : হজ, জাকাত ও প্রায়শ্চিত্ত (কোনো মুসলমান নামাজ-রোজা করতে না পারার প্রায়শ্চিত্ত বা কাফফারাস্বরূপ গরিবকে দান করা)।

(২) ওয়াজের কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে দান। যেমন সাদকা, ফিতরা (ঈদুল ফিতরের দিনে গরিবকে প্রদত্ত) এবং ঈদুল আজহার কোরবানি।

(৩) নফল কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে দান, অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে দান। যেমন_গরিবকে দান করা বা মসজিদ নির্মাণ করা বা সেতু নির্মাণ করা অথবা পথিকদের সুবিধার্থে সরাইখানা স্থাপন করা। উইলে এ তিন শ্রেণির দানের মধ্যে প্রথম শ্রেণির দান দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণী অপেক্ষা এবং দ্বিতীয় শ্রেণির দান তৃতীয় দান অপেক্ষা উত্তম ও অগ্রাধিকার পাবে।

উউইলের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা

মুসলিম আইন অনুযায়ী উইল করার ব্যাপারে তার ব্যতিক্রম সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেগুলো নিচে আলোচনা করা হলো-

  • মুসলিম আইন মোতাবেক একজন মুসলমান উইলকারী যেকোনো অনাত্মীয়কে তার সব সম্পত্তির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ উইলপত্রের মাধ্যমে দান করতে পারে, কিন্তু এর অধিক উইল করতে পারে না।
  • উইলকারী তার কোনো উত্তরাধিকারীর নামে উইলের মাধ্যমে সম্পত্তি দান করতে পারে না। এরূপ দান আইনগত অগ্রাহ্য হবে।
  • উইলকারী তার কোনো উত্তরাধিকারীর নামে উইলপত্রের মাধ্যমে কোনো সম্পত্তি দান করলে মূলত আইন সংগত হবে না বটে; কিন্তু উইলকারীর মৃত্যুর পর তার অন্যান্য উত্তরাধিকারী তা মেনে নিলে সংশ্লিষ্ট উইলটি আইনসিদ্ধ ও কার্যকরী হবে।
  • মুসলিম আইনের বিধানমতে একজন মুসলমান তার অন্যান্য উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে কেবল একজন উত্তরাধিকারীর বরাবরে উইল করতে পারে না।
  • একজন উইলকারী শিয়া আইন মতে তার অন্যান্য উত্তরাধিকারীর অনুমতি বা সম্মতি ছাড়াই তার সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ তার যেকোনো উত্তরাধিকারীকে উইল হিসেবে দান করতে পারে; কিন্তু এক-তৃতীয়াংশের বেশি দান কার্যকরী করতে হলে উইলকারীর অন্যান্য উত্তরাধিকারীর অনুমতি বা সম্মতির প্রয়োজন হয়।
  • উইলকারী তার মৃত্যুর সময় যদি কোনো অস্তিত্বহীন ব্যক্তির নামে উইল করে, তবে উক্ত উইল অবৈধ বলে গণ্য হবে। তবে উইল করার দিন হতে ছয় মাসের মধ্যে কোনো সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে মাতৃগর্ভের সন্তানকে উইলের মাধ্যমে সম্পত্তি দান করে দিতে পারেন।
  • উইলকারীর কোনো উত্তরাধিকারী না থাকলে তিনি তার সব সম্পত্তি যেকোনো অপরিচিত ব্যক্তিকে উইলের মাধ্যমে দান করে দিতে পারেন। মুসলিম আইনে বৈধ নয় এমন কোনো ক্ষেত্রে উইল করা যাবে না।
  • কোনো মুসলমান শর্তসাপেক্ষে উইল করতে পারে না। শর্তসাপেক্ষে উইলের মাধ্যমে দান অবৈধ বলে গণ্য হবে।
  • একজন উইলকারী ভবিষ্যতে পাবে এরূপ উইলপূর্বক দান করতে পারেন না এবং এরূপ দানও অবৈধ।এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি উইলকারী কর্তৃক উইল করার পর বাকি দুই-তৃতীয়াংশ তার ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
  • যেহেতু উইলকারীর মৃত্যুর পর উইল কার্যকরী হয়, সেহেতু উইলকারী তার জীবদ্দশায় যেকোনো সময় উইল রদ করতে পারে।
উইল রদকরণ

উইল বা অছিয়তনামা রদ করা যায়। উইলকারী তার জীবদ্দশায় উইল রদ বা বাতিল করতে পারে। বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে উইলকারী তার উইলপত্র রদ করতে পারে। পদ্ধতিগুলো নিম্নরূপ-

  • উইলকারী তার কৃত উইল লিখিত বা মৌখিক ঘোষণার মাধ্যমে রদ বা প্রত্যাহার করতে পারে।
  • যদি উইলকারী উইলকৃত সম্পত্তিতে এমন কোনো কাজ করে, যার ফলে উক্ত সম্পত্তির পরিবর্তন সাধিত হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট উইলটি রদ হবে।
  • উইলকৃত সম্পত্তিতে যদি উইলকারীর স্বত্বের অবসান ঘটে, তাহলে সংশ্লিষ্ট উইলটি স্বাভাবিকভাবেই রদ হয়ে যাবে।
  • উইল-গ্রহীতার উদ্দেশ্যে যে সম্পত্তি উইল করা হয়, তা যদি উইলকারী উইল করার পর অন্যের কাছে দান বা বিক্রি করে দেয় তাহলে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উইলটি রদ বা প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে গণ্য হবে।
  • উইলকারী আদালতের মাধ্যমেও তার কৃত উইল রদ বা প্রত্যাহার করতে পারবে।

Leave a Comment