ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। ধানের ব্লাস্ট রোগ একটি মারাত্মক ছত্রাকজনিত রোগ যা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে। সময় মতো রোগটি শনাক্ত করতে পারলে এবং সঠিক পদক্ষেপ নিলে ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব।
ধানের ব্লাস্ট রোগ: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার
ব্লাস্ট রোগ ধানের একটি সাধারণ রোগ যা ম্যাগনোপোর্থে ওরাইজি (Magnaporthe oryzae) নামক ছত্রাকের কারণে হয়ে থাকে। এটি ধান গাছের পাতা, কাণ্ড, গিঁট এবং এমনকি ধানের শীষকেও আক্রমণ করতে পারে। আর্দ্র এবং উষ্ণ আবহাওয়া এই রোগের বিস্তার এবং তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
ব্লাস্ট রোগের কারণ
ব্লাস্ট রোগের প্রধান কারণ হলো ম্যাগনোপোর্থে ওরাইজি নামক ছত্রাক। এছাড়াও কিছু অনুকূল পরিবেশ এই রোগের বিস্তারে সাহায্য করে:
- আর্দ্র আবহাওয়া (Relative humidity) : ৮০% -এর বেশি আর্দ্রতা ব্লাস্ট রোগের জন্য অনুকূল।
- উষ্ণ তাপমাত্রা: ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এই রোগের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করে।
- অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার: জমিতে অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার করলে গাছ দুর্বল হয়ে যায় এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
- বৃষ্টিপাত: একটানা বৃষ্টিপাত অথবা শিশির ভেজা আবহাওয়া রোগের জীবাণু ছড়াতে সাহায্য করে।
ব্লাস্ট রোগের লক্ষণ
ব্লাস্ট রোগের লক্ষণগুলো গাছের বিভিন্ন অংশে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। নিচে এর কয়েকটি লক্ষণ আলোচনা করা হলো:
পাতা ব্লাস্ট (Leaf Blast):
- পাতায় ছোট ছোট ডিম্বাকৃতির দাগ দেখা যায়।
- দাগগুলো প্রথমে সবুজ বা ধূসর থাকে, পরে মাঝখানটা সাদা হয়ে যায় এবং চারপাশে গাঢ় বাদামী রঙের বলয় দেখা যায়।
- আক্রান্ত পাতা দ্রুত শুকিয়ে যায়।
কাండ ব্লাস্ট (Node Blast):
- ধান গাছের কাণ্ডের গিঁটে কালো দাগ দেখা যায়।
- আক্রান্ত গিঁট দুর্বল হয়ে ভেঙে যেতে পারে।
- গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
শীষ ব্লাস্ট (Panicle Blast):
- শীষের গোড়ায় বা শীষের ডালের সংযোগস্থলে কালো দাগ দেখা যায়।
- শীষের কিছু অংশ বা সম্পূর্ণ শীষ শুকিয়ে যায়।
- ধানের ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়।
ব্লাস্ট রোগের প্রতিকার
ব্লাস্ট রোগ থেকে ধানকে বাঁচাতে সমন্বিত রোগ ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ আলোচনা করা হলো:
রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার:
- ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী ধানের জাত ব্যবহার করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
- BRRI (বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট) কর্তৃক উদ্ভাবিত আধুনিক ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করুন।
বীজ শোধন:
- বপনের আগে বীজ শোধন করা রোগ প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
- ভিটাভেক্স-২০০ (Vitavex-200) অথবা ট্রাইসাইক্লাজল (Tricyclazole) জাতীয় ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করুন।
সুষম সার ব্যবহার:
- জমিতে সুষম সার ব্যবহার করুন।
- অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
- মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক পরিমাণে সার ব্যবহার করুন।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ:
- আক্রান্ত গাছের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ফেলুন বা মাটি চাপা দিন।
- আগাছা পরিষ্কার রাখুন, কারণ আগাছা রোগের উৎস হতে পারে।
ছত্রাকনাশক ব্যবহার:
- প্রয়োজনে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করুন।
- ম্যানকোজেব (Mancozeb), ট্রাইসাইক্লাজল (Tricyclazole), অথবা কার্বেন্ডাজিম (Carbendazim) জাতীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
- স্প্রে করার সময় গাছের সব অংশ ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধে করণীয়
ব্লাস্ট রোগ একটি মারাত্মক রোগ, তাই এর প্রতিরোধ সবসময় জরুরি। নিচে কিছু অতিরিক্ত টিপস দেওয়া হলো:
- নিয়মিত জমি পরিদর্শন করুন এবং রোগের লক্ষণ দেখা মাত্রই ব্যবস্থা নিন।
- জমিতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করুন, যাতে গাছের গোড়া শুকনো থাকে।
- বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলে আগে থেকেই ছত্রাকনাশক স্প্রে করুন।
- পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জাতের ধান চাষ করুন, এতে রোগের বিস্তার কম হতে পারে।
ধানের ব্লাস্ট রোগ দমনে ব্যবহৃত ছত্রাকনাশক এর তালিকা
ছত্রাকনাশকের নাম | সক্রিয় উপাদান | ব্যবহারের নিয়ম |
---|---|---|
ট্রুপার (Trooper) | আইসোপ্রোথিওলেন ৪০% ইসি | প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করুন |
নাটিভো (Nativo) | টেবুконаজল + ট্রাইফ্লক্সিস্ট্রবিন | প্রতি লিটার পানিতে ০.৬ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করুন |
এমিস্টার টপ (Amistar Top) | এ্যাজোক্সিস্ট্রবিন + ডিফেনোকোনাজল | প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করুন |
এই ব্লগ পোস্টটি আপনাকে ধানের ব্লাস্ট রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এবং এর প্রতিকার করতে সাহায্য করবে। আপনার ফসলকে ব্লাস্ট রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে উপরে দেওয়া পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করুন।