আমন ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এর ফলন কমে গেলে খাদ্য নিরাপত্তায় মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। তাই, আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা: করণীয় ও কৌশল নিয়ে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আমন ধানের উপর প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তন আমন ধানের চাষের উপর নানাবিধ প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রধান প্রভাব নিচে উল্লেখ করা হলো:
- বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন: অনিয়মিত এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, যা আমন ধানের চারা নষ্ট করে দেয় এবং ফলন কমিয়ে দেয়। আবার, অনাবৃষ্টির কারণে খরায় ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- তাপমাত্রা বৃদ্ধি: উচ্চ তাপমাত্রা আমন ধানের ফুল ও ফল ধারণের সময় কমিয়ে দেয়, যার ফলে শস্যের মান খারাপ হয় এবং ফলন কমে যায়।
- লবণাক্ততা বৃদ্ধি: উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। আমন ধান লবণাক্ততার প্রতি সংবেদনশীল হওয়ায় ফলন কমে যায়।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি করে।
আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে করণীয়
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমন ধানকে বাঁচাতে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ আলোচনা করা হলো:
উপযুক্ত জাত নির্বাচন
জলবায়ু সহনশীল এবং উচ্চ ফলনশীল জাতের আমন ধান চাষ করতে হবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) কর্তৃক উদ্ভাবিত বিভিন্ন প্রকার লবণাক্ততা সহনশীল (যেমন ব্রি ধান ৪৭, ব্রি ধান ৬১), খরা সহনশীল (ব্রি ধান ৫৬, ব্রি ধান ৭১) এবং বন্যা সহনশীল (ব্রি ধান ৫১, ব্রি ধান ৭৯) জাত নির্বাচন করে চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
জমি তৈরি ও চারা রোপণ
আমন ধানের ভালো ফলনের জন্য জমি তৈরি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিক সময়ে জমি চাষ করে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। এরপর লাইন করে চারা রোপণ করতে হবে, যাতে পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।
সঠিক সার ব্যবহার
মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার করতে হবে। জৈব সার ব্যবহার করার ওপর জোর দিতে হবে, কারণ এটি মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং পরিবেশের জন্য ভালো। ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি সারের পাশাপাশি দস্তা ও গন্ধক সার ব্যবহার করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
পানি ব্যবস্থাপনা
বৃষ্টি কম হলে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয়।
রোগ ও পোকা দমন
আমন ধানে বিভিন্ন ধরনের রোগ ও পোকার আক্রমণ হতে পারে। নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করে রোগ ও পোকা চিহ্নিত করতে হবে এবং সময় মতো প্রয়োজনীয় কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে, পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত।
আগাছা দমন
আমন ধানের জমিতে আগাছা দেখা দিলে তা দ্রুত দমন করতে হবে। আগাছা দমনের জন্য নিড়ানি ব্যবহার করা যেতে পারে অথবা অনুমোদিত আগাছা নাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে কৌশল
আমন ধানের ফলন বাড়ানোর জন্য কিছু আধুনিক কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। নিচে কয়েকটি কৌশল আলোচনা করা হলো:
কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার
আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি যেমন – ড্রোন ব্যবহার করে জমিতে কীটনাশক স্প্রে করা, স্মার্ট সেন্সর ব্যবহার করে মাটির আর্দ্রতা ও পুষ্টি উপাদান পরিমাপ করা ইত্যাদি ব্যবহার করে ফলন বাড়ানো যায়।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (Integrated Pest Management)
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি না করে রোগ ও পোকা দমন করা যায়। এক্ষেত্রে জৈব কীটনাশক ব্যবহার, পোকা ধরার ফাঁদ ব্যবহার এবং উপকারী পোকা সংরক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়।
কৃষি বীমা
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে কৃষকদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য কৃষি বীমার ব্যবস্থা করতে হবে।
কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ
কৃষকদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং আমন ধানের ফলন বাড়ানোর জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল সম্পর্কে তাদের জানাতে হবে।
টেবিল: আমন ধানের জাত এবং বৈশিষ্ট্য
জাতের নাম | বৈশিষ্ট্য |
---|---|
ব্রি ধান ৪৭ | লবণাক্ততা সহনশীল, উচ্চ ফলনশীল |
ব্রি ধান ৫৬ | খরা সহনশীল, স্বল্প জীবনকাল |
ব্রি ধান ৫১ | বন্যা সহনশীল, লম্বা গাছ |
ব্রি ধান ৬১ | লবণাক্ততা সহনশীল, মাঝারি জীবনকাল |
ব্রি ধান ৭১ | খরা সহনশীল, উচ্চ ফলনশীল |
ব্রি ধান ৭৯ | বন্যা সহনশীল, উচ্চ ফলনশীল |
উপসংহার
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে আমন ধানের ফলন বৃদ্ধি করা একটি চ্যালেঞ্জ। সঠিক জাত নির্বাচন, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার, এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব। সরকার এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করে আমন ধানের উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে।