কিডনি রোগ প্রাথমিক অবস্থায় তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ না করলেও, সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এটি গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। তাই কিডনি সমস্যার লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
নিচে কিডনি রোগের লক্ষণ এবং ডাক্তারগণ যেভাবে পরামর্শ দেন, সেইভাবে প্রতিকার বিষয়ক নির্দেশনা দেওয়া হলো:
কিডনি রোগের লক্ষণ
১. মূত্রে পরিবর্তন:
- মূত্রের রং ফ্যাকাশে বা খুব ঘন হতে পারে।
- মূত্রে ফেনা বা রক্ত দেখা যেতে পারে।
- মূত্রের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে বা কমে যেতে পারে।
- মূত্র ত্যাগ করতে জ্বালাপোড়া হতে পারে।
ডাক্তারের পরামর্শ:
- মূত্রে পরিবর্তন লক্ষ্য করলে প্রথমেই একটি ইউরিন টেস্ট করতে হবে।
- আপনার মূত্রের রং, গন্ধ বা পরিমাণের যেকোনো অস্বাভাবিকতা থাকলে দ্রুত নেফ্রোলজিস্টের সাথে যোগাযোগ করুন।
২. মুখমণ্ডল ও পায়ের ফোলা:
- মুখমণ্ডল, পা, পায়ের গোড়ালি, এবং চোখের নিচে ফোলাভাব দেখা দিলে এটা কিডনি সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।
ডাক্তারের পরামর্শ:
- ফুলে যাওয়ার কারণ হতে পারে কিডনিতে অতিরিক্ত তরল জমা হওয়া। তাই প্রতিদিন আপনার শরীরের ওজন পর্যবেক্ষণ করুন।
- ফোলা থাকলে বেশি জল পান থেকে বিরত থাকুন এবং ডাক্তারকে দেখিয়ে প্রয়োজনে ডায়ুরেটিক ওষুধ সেবন করুন।
৩. ক্লান্তি, দুর্বলতা:
- সারাক্ষণ ক্লান্তি অনুভব করা, দুর্বলতা আসা, এবং মাথা ঘোরা অ্যানিমিয়ার লক্ষণ, যা কিডনি সমস্যার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে।
ডাক্তারের পরামর্শ:
- এই লক্ষণগুলি থাকলে রক্তের হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করানো জরুরি।
- ডাক্তার প্রয়োজনমতো আয়রন বা ইরিথ্রোপোইটিন ইনজেকশন দিতে পারেন।
৪. বমি বমি ভাব এবং বমি:
- কিডনির সমস্যায় রক্তে টক্সিনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা বমি বা বমি বমি ভাব তৈরি করতে পারে।
ডাক্তারের পরামর্শ:
- যদি বমি বা বমি বমি ভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে রক্ত পরীক্ষা করে ক্রিয়েটিনিন এবং ইউরিয়া লেভেল চেক করান।
- টক্সিন নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ ধরনের খাদ্য নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে, যেমন কম প্রোটিন এবং কম লবণযুক্ত খাবার খাওয়া।
৫. শ্বাসকষ্ট:
- ফুসফুসে জল জমলে বা অ্যানিমিয়ার কারণে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
ডাক্তারের পরামর্শ:
- শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত এক্স-রে করিয়ে নিশ্চিত হতে হবে, ফুসফুসে জল জমা হয়েছে কি না।
- শ্বাসকষ্টের মাত্রা বেশি হলে ডায়ালাইসিস বা অন্যান্য চিকিৎসা শুরু করার প্রয়োজন হতে পারে।
৬. রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া:
- কিডনি রোগে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ডাক্তারের পরামর্শ:
- রক্তচাপ নিয়মিত মাপুন এবং উচ্চ রক্তচাপের জন্য প্রেসার কন্ট্রোলিং ওষুধ গ্রহণ করুন।
- প্রয়োজন হলে লবণযুক্ত খাবার কমিয়ে দিন এবং নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
কিডনি রোগের কারণ
কিডনি রোগের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:
- ডায়াবেটিস: এটি কিডনি ক্ষতির অন্যতম প্রধান কারণ। রক্তে উচ্চ মাত্রার শর্করা কিডনি ফিল্টারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
- উচ্চ রক্তচাপ: দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপ কিডনির ক্ষতি করে।
- অতিরিক্ত ওষুধ সেবন: কিছু ওষুধ বিশেষ করে ব্যথানাশক ওষুধ কিডনির কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
- বংশগত কারণ: কিডনি রোগ অনেক সময় বংশগতও হতে পারে।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস কিডনি সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়।
কিডনি রোগের প্রতিকার
১. খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ:
- কম লবণ, কম প্রোটিন ও কম ফসফরাস যুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
- বেশি পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার (যেমন: কলা, কমলালেবু) এড়িয়ে চলুন।
ডাক্তারের পরামর্শ:
- পুষ্টিবিদের সাথে পরামর্শ করে খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করুন।
২. ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন:
- কিডনি পুরোপুরি কাজ করা বন্ধ করে দিলে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন একমাত্র সমাধান হতে পারে।
ডাক্তারের পরামর্শ:
- যদি ইজিএফআর (eGFR) ১৫-এর নিচে নেমে যায়, তবে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে।
- ডায়ালাইসিসের সময়সূচি নির্ধারণের জন্য আপনার নেফ্রোলজিস্টের সাথে পরামর্শ করুন।
৩. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা:
- রক্তচাপ, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা, এবং কিডনির কার্যক্ষমতা নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত।
ডাক্তারের পরামর্শ:
- প্রতি ৩ থেকে ৬ মাস পর কিডনির অবস্থা যাচাই করতে রুটিন ব্লাড ও ইউরিন টেস্ট করান।
৪. ওষুধ সেবন:
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ব্লাড প্রেসার কন্ট্রোল ওষুধ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ সেবন করুন।
ডাক্তারের পরামর্শ:
- নিজের ইচ্ছামতো ওষুধ পরিবর্তন করবেন না এবং কোনো ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করবেন না।
উপসংহার
কিডনি রোগের ক্ষেত্রে দ্রুত শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, এবং ওষুধ সেবন করে কিডনি রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করান।